নেতৃত্ব ও আস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক

নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জিং বিষয়। নামে নেতা আর কাজে নেতা এক নয়। নেতার প্রতি প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী বা দেশের মানুষের আস্থা থাকতে হয়। কিন্তু সহকর্মী বা মানুষের আস্থালাভ করাও খুব সহজ কথা নয়। নেতা কমিউনিটির উদ্দেশ্যে বা দেশের স্বার্থে কাজ করেন কিনা; নেতার কথা, নেতার নির্দেশনা যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবানুগ কিনা এমন সব বিষয় নেতার প্রতি আস্থা বা অনাস্থা সৃষ্টি করতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে বড় কথা নেতাকে অনুসারীরা নিজেদের নেতা হিসেবে মনেপ্রাণে সর্বান্তকরণে মেনে নেন কিনা তা নেতা এবং অনুসারী উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। অনুসারীগণ সব সময়ই নেতার চারিত্রিক দিক ও নেতার কাজ সচেতনভাবে অনুসরণ ও পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।

নেতৃত্বের পজিশনে থাকলেই একজন নেতা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন হবেন বিষয়টি এমন সরলসোজা নয়। নেতাকে কাজের মাধ্যমে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে পরীক্ষার মাধ্যমে অধীনস্ত বা অনুসারীদের বিশ্বাস বা আস্থা অর্জন করতে হয়। সুসংহত ব্যক্তিত্ব,কর্মতৎপরতা,ন্যায়পরায়ণতা,দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, কল্যাণকামী ও ত্যাগী মনোভাব এমন সব ইতিবাচক চারিত্রিক গুণের মাধ্যমে নেতাকে অন্যদের আস্থা অর্জন করতে হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা,চেগুয়েভারা,  নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধীর মতো নেতারা ছিলেন এসব গুণে গুনান্বিত নেতা।

নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নেতাকে ১০০% আস্থা অর্জন করতে হয়। এক্ষেত্রে ৬০% বা ৮০% আস্থা বলে কিছু নেই। আবার নেতৃত্বে সাময়িক আস্থা বলেও কিছু নেই। সময় ও সুযোগ অনুযায়ী যে নেতৃত্ব পক্ষপাতমূলক অবস্থান গ্রহণ করেন ঐ নেতৃত্বের প্রতি অধীনস্ত, অনুসারী বা দেশের সাধারণ মানুষের কোন আস্থা থাকে না। এজন্যই বলা হয় “Leadership is indivisible and trust is unquestionable.”

দুর্বল বা প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্র, অশালী ও অমার্জিত কথাবার্তা নেতার অন্যান্য সকল গুণাগুণকে ম্লান করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে নেতৃত্বের সকল প্রভাবই ক্ষুন্ন ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। নেতৃত্ব ও আস্থা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আস্থার মাধ্যমেই নেতার সাথে অধীনস্ত বা অনুসারীদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মানুষ যাকে আস্থাশীল মনে করে না তার প্রতি আনুগত্যও প্রকাশ করে না। প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে দুর্বল ও আস্থাহীন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনে বড় অন্তরায়। কারণ নেতার প্রতি আনুগত্যের অভাবই অনুসারীদেরকে তার বা তাদের আদেশ পালনে বিমুখ ও বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। শুধু পজিশনের কারণেই অনুসারীরা নেতার প্রতি শতভাগ আনুগত্য স্বীকার করে না। বরং নেতার কথা ও কাজ, স্বভাব-চরিত্র,নির্দেশদানের ক্ষমতা,অনুসারীদের প্রতি মমত্ববোধ,অনুসারীদেরকে নিজের লোক বলে স্বীকার করা এবং কাজের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ,দেশপ্রেম ইত্যাদি গুণাবলীর দ্বারাই নেতৃত্ব অনুসারীদের কাছে আস্থাভাজন হন।

মহাবীর আলেকজান্ডার ১০ বছরব্যাপী অপরাজেয় যুদ্ধে গ্রীস, মিশর এবং বৃহত্তর পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে নিয়েছেলিনে এবং সেসব স্থানে তাঁর শাসন কায়েম করেছিলেন।

আলেকজান্ডার তারপরও খুশি ছিলেন না। তিনি ভারতবর্ষ জয়ের উদ্দেশ্যে তাঁর অভিযান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১০ বছর ধরে অব্যাহত যুদ্ধ করার কারণে এবং এ দীর্ঘ সময় বাড়ি থেকে তথা পরিবার-পরিজন হতে দূরে থাকার কারণে তাঁর সৈন্যবাহিনী আরেকটি যুদ্ধ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। আলকেজান্ডার সৈন্যদের মধ্যে তাঁর প্রতি আস্থার সংকট লক্ষ্য করে তাদেরকে উজ্জ্বীবিত করার জন্য এক ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি তোমাদের কমান্ডার হিসেবে, তোমাদের ক্লান্তিকর যাত্রা এবং দুর্ভোগময় অভিযানের শরিক না হয়ে প্রথমবারের মতো তোমাদের নিরাশ হওয়াকে দোষ দিতে পারি না।

যখন সমগ্র এশিয়া জয় করা হবে, তখন প্রকৃতপক্ষে আমি আমাদের প্রত্যাশার সন্তুষ্টিকে ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে যাব: তোমরা প্রত্যেকে ধনসম্পদ ও ক্ষমতার যে সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত পাওয়ার আশা পোষণ করো তা ছাড়িয়ে যাব, এবং যারা বাড়ি ফিরে যেতে চাও তাদেরকে ফিরে যেতে দেওয়া হবে, আমার সাথে অথবা আমাকে ছাড়া। যারা থেকে যাবে তাদেরকে আমি যারা ফিরে যাবে তাদের কাছে হিংসার উপযুক্ত করে তুলব।”

অনুসারীদের মধ্যে আস্থার সংকট যে কোন সময়ই তৈরী হতে পারে। একজন নেতার পক্ষে তা বুঝতে পারা এবং তদানুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাও নেতৃত্বের বড় গুণ।

  • মোঃ বদিউজ্জামান

যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী

-মোঃ বদিউজ্জামান ১১/০৭/২০২৪ খ্রি.

রবীন্দ্র সাহিত্য এখনো অনেক সময় কঠিন মনে হয়। আবার ছোট বেলায় পড়া ‘বীরপুরুষ’ কবিতার কথা মনে হলে এমন ভাবনায় ছেদ পড়ে। অর্থের পিছনে যে অর্থ থাকে, ভাবনার পিছনে যে থাকে ভাবনা, শক্তির পিছনে যে মহাশক্তি থাকে রবীন্দ্র সাহিত্য যত বেশী পড়ি ততবেশী তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। রবীন্দ্র সাহিত্য কতটুকু বুঝতে পারি তার চেয়ে আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ সাহিত্য পড়ে আমি ভাসতে পারি অকূল সাগরে, ডুবতে পারি অথৈ মহাসাগরে, উড়তে পারি মহাকাশে। জানা ও বুঝার বিস্তর ফারাক আছে তা জানি। তাই কখনো জানার জন্য, কখনো বুঝার জন্য আবার কখনো উপলব্ধির গভীর শিখড়ে পৌঁছার জন্য রবীন্দ্র সাহিত্যে অবগাহন করি। কোন কোন বিষয় বারবার পড়ি। কবি গুরুর ‘সোনার তরী’ কবিতা পড়ে মনের গভীরে প্রশ্ন জেগেছে এ কবিতায় তিনি আসলে কি বলতে বা বুঝাতে চেয়েছে?  কখনো তাঁর কথা আমি বুঝতে পারি আবার কখনো বুঝতে পারি না। এই যে ‘যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী’ বলতে তিনি কিসের আবেগ প্রকাশ করেছেন? কি ছিল নৌকায়?ধান। ধান আসলে কীসের প্রতীক? সম্পদ নাকি জীবন নাকি সময়ের? সোনার তরী কি?সোনার তরী কি মানুষের জীবন?জীবনের সময়? আমাদের কাছে বিবেচিত মূল্যবান সম্পদ? ভালোবাসা? স্নেহ? আবেগ? অনুভূতি?প্রেম?নাকি কালের গভীরে সব কিছুর হারিয়ে যাওয়া?হাজার বার চিন্তা করেও আমি এ জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর পাইনি । এ বছরের ৭ই জানুয়ারী যখন আমার জন্মদাতা ইহধাম ত্যাগ করেন তখন আমার মনে হয়েছে ‘সোনার তরী’ মানে সময়। সময়ের তরীতে ভর করে আমার চিরচেনা, চিরজানা,পরমপ্রিয়, চরম ভালোবাসার ধন রওয়ানা হয়েছিলেন অনন্তকালের মালিক যিনি তাঁর কাছে। সময় তরীর আকার-আকৃতি জানি না, লগি বৈঠার কোন কিছু চিনি না,মাঝি-মাল্লা কারা তাও জানি না শুধু জানি একজন মালিক আছেন যিনি সব কিছুর নিয়ন্তা, যিনি সবার কাছে অদৃশ্য আবার সবার কাছে দৃশ্যমান দয়া,করুণা ভালোবাসা, প্রেম, মুগ্ধতা, বিস্ময়,জিজ্ঞাসা, অনন্ত জিজ্ঞাসা রুপে। তাঁরই কাছে সব ধায়, তাঁরই কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি বিশ্বের সবকিছুর মধ্যে। তাই ভালোবাসার, প্রেমের, প্রকৃতির কবি গেয়েছেন,

“ ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা

প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে

যায় যেন মোর সকল গভীর আশা

প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে

 

চিত্ত মম যখন যেথায় থাকে

সাড়া যেন দেয় সে তোমার ডাকে

যত বাধা সব টুটে যায় যেন

প্রভু, তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে।”

 

বিশ্বের সবার ও সব কিছুর মধ্যে পরিপূর্ণতায় ভরে উঠার বাসনা কাজ করে। কিন্তু সব কিছুই কি পরিপূর্ণতায় ভরে উঠতে পারে?সবাই কি পরিপূর্ণতায় সিক্ত হতে পারে?পরিপূর্ণতার কি কোন পরিপূর্ণ সংজ্ঞা আছে? আমার নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করার ভাবনা ও তৃপ্তি কি অন্যের পরিপূর্ণ হওয়ার পথে বাধা?অন্যকেও পরিপূর্ণ হয়ে উঠার সুযোগ দেওয়া কি আমার, আমাদের দায়িত্ব নয়?চূড়ান্ত পরিপূর্ণতা কীসে? এমনি ধারা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসাও মনের মধ্যে কাজ করে। যখন পরিপূর্ণতার তৃপ্তি নিয়ে আর সন্তুষ্টিতে নিজেকে ভরপুর মনে হয় তখনই হয়তো সময় এমন কোন দফা নিয়ে হাজির হয় যখন সময়ের কাছে আত্নসমর্পনেই তৃপ্তি, আনন্দ আর মুক্তি। আমাদের পরিপূর্ণতার অংশ,আমাদের আপনজন যখন নিজেকে পরিপূর্ণ করার আনন্দে বিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে দেয়,আলো হয়ে উঠার তীব্র বাসনায় অনিশ্চয়তাকেও মেনে নিয়ে ছুটতে থাকে তখন আমরা বুঝতে পারি পরম প্রভুর ডাকে সে ছুটছে নবসৃষ্টির আনন্দে। এ ছোটাতে থাকে তৃপ্তি, সৃষ্টির আনন্দ, মুক্তির উচ্ছ্বাস,বিশ্বের নাগরিক হয়ে বিশ্বজনের সাথে মিলিত হওয়ার অবাধ বাসনা। এ বাসনা পূরণের যাত্রায় আমাদের পরিপূর্ণতায় ভাঙ্গন ধরে, আমরা হারানোর বেদনাভারে আক্রান্ত হই কিন্তু এ ভাঙ্গনেই নতুন সৃষ্টির জোয়ার আসে। সে জোয়ারকে রুদ্ধ করলে সময়ের দাবিকে রুদ্ধ করা হয়, সৃষ্টির পথে বাধার সৃষ্টি করা হয়, মুক্তির পথকে সংকুচিত করা হয়। সময় ছিনিয়ে নেয়, সময় কেড়ে নেয়। কিন্তু সব ছিনিয়ে নেওয়া, সব কেড়ে নেওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়। পরিপূর্ণ হয়ে উঠার জন্য সময়ের ছিনিয়ে নেওয়াকে মেনে নিতে হয়। মৃত্যুযাত্রাও কখনো কখনো মুক্তিযাত্রার মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে। তখনও আমরা সময়ের ছিনিয়ে নেওয়াকে অন্তর হতে মানতে পারি না। কিন্তু সময় তো আমাদের চাওয়া-পাওয়া, মেনে নেওয়া, মেনে না নেওয়াকে পরোয়া করে না। অতএব ‘যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী’ এ আক্ষেপ তখনো শুধু আক্ষেপ ও আর্তি হিসেবেই সময়ের প্রবাহে ভেসে বেড়ায়। আর সৃষ্টিই যেখানে মহত্বের মর্যাদা নিয়ে হাজির হয় সেখানে “যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী” এ বেদনাবোধকে শতকষ্ট হলেও আনন্দবোধের মহিমায় মেনে নিতে হয় । তাতে নিজেদের পরিপূর্ণতাবোধের তৃপ্তি কমলেও অন্যের পরিপূর্ণ হওয়ার আনন্দযাত্রাকে উপযাপন করা হয়,নবসৃ্ষ্টির বিজয়যাত্রার মহিমা কীর্তন করা হয়। সময় তার আপনবেগে মিলন ও বিচ্ছেদের খেলায় মত্ত। সময় তরীর এ জয়যাত্রাকে রুদ্ধ করার সাধ্য আছে কার?

নেইভাসা লেকে ভেসে চলা, মেঘ-পাহাড়ের সাথে কথামালা

নেইভাসা লেকে ভেসে চলা, মেঘ-পাহাড়ের সাথে কথামালা – মোঃ বদিউজ্জামান

পর্ব-২

আমাদের কল্পনা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায়। বিশেষ করে তা যদি মনের  মাধুরীতে রাঙানো কোন স্থান, দৃশ্য, প্রেক্ষাপট বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে হয় । মনের ভেতর একটা উথাল-পাতাল ভাবনা নিয়ে আমরা সেই কাঙ্খিত স্থান, দৃশ্য বা ঘটনার দিকে যতটা এগুতে থাকি ততই বাড়তে থাকে আমাদের হৃদয় মনের উত্তেজনা ও চাপ। কল্পিত অপরুপ সুন্দর দেখার উত্তেজনাবোধ নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি লেকের মাঝখানের দ্বীপের দিকে।মনের উত্তেজনার বশে হঠাৎ করেই লেকের পানিতেও যেন গতি ও ঢেউ লক্ষ্য করি। হঠাৎ কিছুটা দমকা হাওয়া কোথা হতে যেন উড়ে আসে। হাওয়ার বেগের সাথে সাথে বাড়তে থাকে ঢেউয়ের বেগ ও গতি। ঘাট হতে নৌকাতে রওনা হওয়ার সময় একটুও ঢেউ ছিল না। লেকের ভেতর দিকে যতটা এগুতে থাকি ঢেউয়ের আকৃতি ক্রমিই বড় হয়ে উঠতে থাকে। পুরো লেক জুড়ে লক্ষ লক্ষ ঢেউ আর ঢেউ। দেখে মনে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ সাপের ফনা যেন সমান তালে নেচে চলেছে। যেখানে সূর্যের আলো পড়ছে সেখানকার পানির প্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে গলিত রুপার সাগরে ভাসছি। সেই রুপার মত পানির উপর সূর্যের আলো পড়ে চোখের তারায় তারায় নাচছে আলোর বিন্দু। পিলপিল করে ঢেউ এগিয়ে এসে নৌকার গাঁয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। ওদিকে শাঁ শাঁ করে পাখির দল উড়ে যাচ্ছে বিচিত্র কলরব তুলে। আবার কোন কোন পাখির ঝাঁক চক্রাকারে ঘুরছে লেকের উপর। গলা লম্বাওয়ালা হাঁস জাতীয় পাখি বিকট আওয়াজ করে হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে নিমেষেই গায়েব হয়ে চলে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার আড়ালে। কোথা হতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি গায়ে এসে পড়ল। খেয়াল করে দেখলাম একখন্ড মেঘ মাথার উপর ঝরে পড়ার অপেক্ষায় ঘোমটা দিয়ে অপেক্ষা করছে যেন আদেশ পেলেই ঝরঝর করে নেমে পড়বে নেইভাসার জলে। বেশ শংকায় পড়ে গেলাম। সাথে ছাতা একটা আছে । কিন্তু বাতাসে তা ঠিকে থাকবে এমন ভরসা পেলাম না। টিনের নৌকা বাতাসে এদিক ও দিক তুলছে তো তুলছেই। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আর ভাবছি নৌকা ডুবলে উদ্ধারকারী নৌকা আসতে কতক্ষণ দেরী হতে পারে। ততক্ষণ আমরা নেইভাসার জলে ভেসে থাকতে পারব তো! নাকি ঠাঁই হবে নেইভাসার অতল কালো জলে? এরই মধ্যে কেউ একজন নৌকার একপাশ হতে অন্যপাশে স্থান বদল করতে গিয়ে নৌকায় একঝলক পানি তুলে ফেলল। বলিহারী মানুষের আক্কেল আর জ্ঞান! কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ ফুস করে কালো দুটি পাখি ছড় ছড় শব্দ করে পানির ওপর দিয়ে যেন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বহুদূর পর্যন্ত ছুটে গেল। খেয়াল করে দেখলাম দুটি ঢাউস আকৃতির পানকৌড়ির কেরামতি। কালো মেঘের সাজগোজ দেখে যেন এদের মনে আনন্দের বান ডেকেছে। নাকি বিদেশী অতিথিকে আনন্দ দেয়ার দায় পড়েছে তাদের ওপর! মানুষ, প্রকৃতি আর পশু-পাখি কেউ তো আসলে আলাদা না। সেই প্রাকৃতিহাসিক কাল হতেই তো সবার একসাথে বসবাস ছিল। এখন না মানুষ নিজেদেরকে প্রকৃতি থেকে আলাদা ভাবতে চায়। সবার উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবী নিয়ে নিজেদেরকে জাতে তুলতে চায়! বিনাশ করতে চায় সৃষ্টির সব সুন্দর সূত্র আর নান্দনিকতা। আসলে তো সবাই প্রকৃতিরই সন্তান। পানকৌড়ির আনন্দ দেখে মনে মনে বলে উঠলাম সাবাস পানকৌড়ি! সাবাস! এ সময় আমার মাথায় এলো আল মাহমুদের কবিতার কথা। কি যে এক ঝামেলা! যখন যা মনে হবার কথা নয় তাই মনে হবে। তিনি ‘পানকৌড়ির রক্ত’ নামে একটা গল্পগ্রন্থ লিখেছেন। আমাদের সামনে পিছনে আর কোন নৌকা দেখা যাচ্ছিল না। মাঝিকে বললাম,‘সাবধানে চালাও।’ তার এক জবাব, ‘চিন্তা করো না।’ মনে মনে বললাম, ব্যাটা চিন্তা করলেই তুমি কি করতে পারবা আর না করলেই বা তুমি কি করতে পারবা তাকি আর  আমরা জানি না? তুমি তো ব্যাটা উগালি খাবার পয়সা পেলেই খুশী । (উগালি কেনিয়ানদের একজাতীয় খাবার। আমাদের দেশের ভাপা পিঠার মতো। ঢাকা শহরের হাতের তালুতে দেখা যায় না এমন ভাপা পিঠা নয়। বিশাল আকৃতির ভাপা পিঠা। সাদা চাউলের অথবা কাউনের চাউলের ভাপা পিঠা। সামান্য চাপ দিলেই মোমের মতো গলে যেত। সে বহুকাল আগের কথা মা যখন এগুলো বানাত তখনকার কথা মনে হলো। কেনিয়ানরা অবশ্য সবজি দিয়ে খায়। হাল আমলে মাংস যোগ হয়েছে। কিন্তু তাদের কজনের ভাগ্যে আর মাংস জোটে?)। যাত্রী মরল না বাঁচল তাতে তোমার কী? আমিও ভাবাভাবি বাদ দিয়ে লেকের আয়তন পরিমান করার চেষ্টা করলাম। নাহ! আন্দাজ করা সম্ভব নয় । যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। হিসাব করে থৈ পাওয়া যাবে না। তাই  প্রকৃতি দর্শন আর ছবি তোলায় মন দেই। মেঘ ভেসে এলে মেঘের রঙে পানির রঙ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। মেঘ সরে গেলে পানি ভিন্ন রঙধারণ করছে।  মেঘ, পানি, ঢেউ আর পাহাড়ের খেলা দেখতে দেখতেই কুড়ি মিনিট কেটে গেল কিভাবে জানি না। বিচিত্র পাখির ডাকে সামনের পানে তাকালাম। বিস্ময়ে নেচে উঠল মনপ্রাণ! সামনে হরিণ, জেব্রা, বানর, ওয়াইল্ড বিষ্টের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে যে যার ইচ্ছামত। কালোমুখ বানরের দলের কেউ কেউ মাঠে ছুটে যাচ্ছে তো কেউ কেউ মরা গাছের শাখায় তরতর করে উঠে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার রোদে গাঁ মেলে দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। বালিহাঁসের মতো দেখতে হাঁসের ঝাঁক কলরব করে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করছে আর খাবার খুঁজে নিচ্ছে পানিতে ডুব সাঁতার কেটে। লম্বা লেজওয়ালা ওটা কি পাখী? দুপায়ের উপর ভর দিয়ে বুক পর্যন্ত পানিতে ভাসিয়ে ঘাড়ের উপর সাদা, কালো লম্বা গলা আর লম্বা ঠোঁটের মাঝখানে কালো দাগওয়ালা স্যাডেল বিলড সারস প্রজাতির বিশালাকৃতির পাখিটি যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিকারের আশায়। একঝাঁক হাফ-কলারড কিঙফিশার রঙের বাহার ছড়িয়ে এ গাছে ও গাছে উড়ছে আর ঝুপ করে পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করছে। জলের কিনারে নানা প্রজাতির পাখিদের মৎস্য শিকারের ধুম পড়েছে। এদের বেশীর ভাগ পাখির নাম জানি না।

নৌকা দেখে হরিণের দল যেন স্থবির হয়ে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখে দুনিয়ার বিস্ময় নিয়ে দেখছে আমাদের। দেখতে দেখতেই তাদের সাথে যোগদিল আরেক দল শিংওয়ালা হরিণের দল। দলে কতগুলো শিশু হরিণ তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে তো লাফাচ্ছেই।

জেব্রার দলের যেন কোন বিকার নেই। আপন মনে ঘাস খাচ্ছে তারা। কারা এলো আর কারা গেলো তাতে তাদের কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। হঠাৎ কী হলো জানি না। তারা দিগবিদিক ছুটাছুটি শুরু করল। তাদের দৌঁড় প্রতিযোগিতার দিকে তাকাতে না তাকাতেই পেলিকানের ডাক কানে এলো। একঝাঁক সাদা পেলিক্যান খাবার খোঁজায় ব্যস্ত। কতগুলো পেলিক্যান দলছুট হয়ে জলকেলীতে মত্ত। পাখা ঝাপটাচ্ছে আর কলরব করছে। এত বড় বড় পেলিক্যান আগে কখনো দেখিনি। কি মনে করে তারা একসাথে উড়াল দিলো। উড়ে অবশ্য খুব বেশী দূরে গেল না। কিন্তু পুরো দল যখন উড়াল দিলো তখন অনিন্দ্যসুন্দর এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। উড়াল দিয়ে আমাদের বুঝাল যে তারা উড়তেও পারে! মাঝিকে কিছু সময়ের জন্য নৌকা স্থির করে চুপচাপ বসে থাকতে বললাম। সিদ্ধান্ত হলো কেউ কোন কথা বলবে না। একদম নিঃশব্দ নীরবতা ও মৌনতা পালনের প্রতিজ্ঞা নিলাম। কানে ভেসে আসছে হরিণের ডাক, জেব্রার ডাক আর নাম না জানা পাখির গান, কলরব। নৌকায় চারজন মানুষ কিন্তু যেন কেউ নেই নৌকায় এমন নীরবতা বিরাজ করছে। সবাই নিস্তব্ধ বসে আছি। অনেকক্ষণ পর নতুন এক শব্দে আমাদের তন্ময়তা ভেঙ্গে খান খান হলো। দশ-বারোটি ওয়াইল্ড বিষ্ট একে অন্যকে সশব্দে তাড়া করতে করতে একদম পানির কিনারে এসে হাজির হলো। বিচিত্র তাদের গলার স্বর যা আগে কখনো শোনার সৌভাগ্য হয়নি। এদের দৌঁড়াদৌঁড়ি ও ডাকাডাকি দেখে শুরু হয়ে গেছে বানরের দলের ডাকাডাকি, লাফালাফি। এখানে হরিণের শরীরের রঙ যেন উজ্জ্বলতায় চমকাচ্ছে। প্রতিটি প্রাণী হৃষ্টপুষ্ট আর স্বাস্থ্যবান। খাবারের পাশাপাশি নীরব নির্ভয় প্রকৃতি যেন তাদের জীবনের সব শঙ্কা কেড়ে নিয়েছে। দিয়েছে অনাবিল আনন্দে জীবন উপভোগের অবারিত সুযোগ।

এবার নৌকা এগুতে থাকলো সামনের পানে। উদ্দেশ্য জিরাফ দেখা। কিন্তু জিরাফের দেখা মিলছে না। কিছুটা বাঁক ঘুরতেই দেখা মিলল আরেক ঝাঁক পেলিক্যানের। কিছু পেলিক্যান পানিতে খাবার খোঁজায় ব্যস্ত আর কিছু পেলিক্যান সারিবদ্ধভাবে রোদে গাঁ মেলে বসে আছে। মাঝি কোন প্রকার শব্দ করতে নিষেধ করল। কিন্তু আমরা শব্দ না করলে কী হবে পেলিক্যানের দল হঠাৎ করে বিকট আওয়াজ করতে করতে পানিতে নেমে গেল। আমাদের নৌকা হতে খানিকটা দূরে একটি নৌকা এসে ফিরল। নৌকায় বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় নারী-পুরুষকে দেখা গেল। তারা একদম চুপচাপ।বাইনোকুলার দিয়ে দেখছে আর নানা ধরনের ক্যামেরায় ছবি তুলছে। মাঝিকে আমরা পুরো দ্বীপটা ঘুরে দেখাতে প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু তার ঐ এক কথা ফোন দিয়ে মালিকের সাথে আগে কথা বলতে হবে। যতই বলি ঘন্টা হিসেবে টাকা বাড়িয়ে দেব তবু তার কথা একটাই মালিকের সাথে কথা বলতে হবে।

আমাদের ক্রয় করা সময় শেষ। এবার ফিরতে হবে। কিন্তু ঢেউ তখনও কমেনি। তবু ফিরতে হবে। মাঝি নৌকা ঘুরাল। দূরে পাহাড়, গ্রাম, বিশালাকৃতির গাছের সাড়ি সাড়ি মেলা আর মেঘের মেলার মিলন দেখে মনে হলো আরও কিছুটা সময় যদি থাকা যেতো। কিন্তু জীবনের সময় বড় কম। জীবনের সঞ্চয় আরও কম। তাই বুঝি কবিগুরু বলেছেন,“হায়রে হৃদয় তোমার সঞ্চয়, দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।”

নৌকা চলছে ঘাটের দিকে। চলতে চলতে নৌকা এসে থামল আরেকটি স্থানে যেখানে হাজার পাখির মেলা বসেছে। পাখির মেলার মাঝে ৮-১০টি ওয়াইল্ড বিষ্ট মনের সুখে ঘাস খাচ্ছে। এগুলো আকৃতিতে কিছুটা ছোট হলেও ওজনে কমপক্ষে ৫০-৬০ কেজি হবে।  অন্য কেউ নামল না। আমি নেমে খুব কাছে গেলাম। তাদের সাথে ছবি তুললাম। ওদের তেমন কোন ভাবান্তর দেখলাম না। কেয়ারটেকার কিছু পয়সার বায়না ধরল। অগত্যা কিছু পয়সা দিতে হলো। কিছু তো দিতে হয়। জীবনের ‍সব সঞ্চয় তো শুধু নিজের জন্য নয়। পরম প্রভু কার রিজিক কার কাছে জমা রেখেছেন তা আমাদের সীমিত চিন্তা শক্তিতে সব সময় বোধগম্য নয়। নেইভাসা লেকের জেমস বা গোমেজের চোখের ঝিলিক এখনও আমার চোখের তারায় নেচে উঠে, ছন্দসুরে কথা কয়। বিশ্বপ্রকৃতির স্রষ্টা যিনি সব কিছুতে তার মহিমা প্রকাশিত,তাঁর  গুণগান ও জয় সর্বত্র।

নেইভাসা লেকে ভেসে চলা, মেঘ-পাহাড়ের সাথে কথামালা

নেইভাসা লেকে ভেসে চলা, মেঘ-পাহাড়ের সাথে কথামালা -মোঃ বদিউজ্জামান
পর্ব-১

কেনিয়া দেশটির নামকরণ হয়েছে মাউন্ট কেনিয়ার নামানুসারে। এই পর্বতের চূড়া সাদা বরফে ঢাকা থাকে। এর আশেপাশে যারা বসবাস করে তারা কিকুয়ু নামে পরিচিত। আটটি অঞ্চলে বিভক্ত কেনিয়া প্রকৃতির নানা বিস্ময়ে ভরপুর। সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকেরা আসেন কেনিয়া সফরে। আমার মতো বাঙালের তো সে দেশ সফরে যাওয়া কল্পনার অতীত ব্যাপার। কিন্তু সরকারী কাজ উপলক্ষ্যে এমন দুর্লভ সুযোগ যখন এসে গেল তখন আনন্দে উল্লসিত হওয়ার মতোই ঘটনা বটে। কেনিয়ার কোথায় যাব কি দেখব এ বিষয়ে নানাজন নানা পরামর্শ দিতে থাকলেন। ঘুরেফিরে মাছাইমারা সাফারীর কথা সবাই বলল। তাদের কথা শুনে মনে হলো আর কিছু না দেখলেও মাছাইমারা দেখতেই হবে। নির্ধারিত সময়ে আমরা যখন কেনিয়াতে পৌঁছালাম এবং অফিসের লোকজনের সাথে কথা বললাম তখন কিছুটা হতাশই হলাম। আইনশৃংখলাজনিত সমস্যার কথা ঘুরেফিরে শুনতে পেলাম। দ্বন্দ্ব আর ধন্দে পড়ে গেলাম। তাহলে কি কিছুই না দেখে ফিরে যেতে হবে? এমনি পরিস্থিতির মধ্যেই আমরা দাপ্তরিক ছুটির দিনে বের হলাম নেইভাসা লেক (Naivasha Lake) দেখার জন্য। নাইরোবি হতে লেক নেইভাসার দুরত্ব প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। গাড়ী প্রায় ২ ঘন্টা ত্রিশ মিনিট সময় লাগে। নাইরোবি হতে বের হয়ে হাইওয়েতে উঠার পর সারাটা রাস্তাই মসৃন ও জ্যামমুক্ত। অবশ্য স্থানে স্থানে পাহাড় ধ্বসের কারণে কিছু ডি-রুটেড হয়ে চলতে হয়। তবে তা খুব সীমিত। হাইওয়ে পুলিশের নানা র্কীর্তিকলাপও অবশ্য নজরে পরতে পারে যদি চোখকান খোলা রাখা যায়। পাহাড়ের ভেতরে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে একেবেঁকে।দুপাশে পাইনগাছসহ নানা প্রজাতির গাছেরা শিড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় মেঘেরা এখানে গাছের মাথায় স্থায়ী আবাস গড়ে নিয়েছে। বিভিন্ন ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালে চারিদিকে পাহাড়ের মধ্যে বিস্তৃত মালভূমির মতো এলাকা দেখা যায়। ভালো করে তাকালে মেঘের আবছায়ার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের কোলের ও সমতলভূমির ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাটের ছবি দেখা যায়। কোথাও কোথাও হালকা মেঘের বাতাসে ভেসে বেড়ানো দেখে ধোয়ার ছড়াছড়ি বলে ভ্রম হয়। কোথাও কোথাও বেশ খোলামেলা প্রান্তর। প্রান্তর হতে দূরে বহু দূরে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। প্রান্তরে লাল কাপড় পড়ে মাছাই উপজাতির লোকেরা গরু ছাগল চড়াচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ রেলগাড়ীর হুস হুস আওয়াজ কানে আসে । তাকিয়ে দেখি ট্রেন যাচ্ছে। রাস্তায় তরুন নারী-পুরুষ ও বালক বালিকারা বাদাম, কমলা, কলা, ছফেদা বিক্রি করছে। অবাক করা ব্যাপার হলো কাউকে সিগারেট বা বিড়ি বিক্রি করতে দেখলাম না। অবশ্য কেউ কেউ পানি বিক্রি করছে কিন্তু কোক বিক্রি করছে না। প্রচন্ড রোদের মধ্যে তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব জিনিস বিক্রি করছে। কেউ কেউ অবশ্য আমাদের দেশের মাথালের মতো বস্তু বা টুপি পড়ে আছে। রাস্তার পাশের ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালেই হকার এসে হাজির হয়। কিছু একটা কেনার জন্য পীড়াপীড়া করতে থাকে। হারুনর রশিদ সাহেব আগেই বলে দিয়েছে এরা যে কোন পণ্য ৪/৫ গুণ বেশী দাম হাকে। সহজ উপায় হচ্ছে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করা। আন্দাজ করে যে কোন দাম বললেই ঠকার শতভাগ সম্ভাবনা। পাহাড়, মেঘ আর বন-বনানীর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে আসি লেক নেইভাসার কাছাকাছি। চার রাস্তার মোড়ে রাস্তার দিকনির্দেশক চিহ্ন নেইভাসার পথ দেখাচ্ছিল। কিছু কিছু সাইনবোর্ডে জলহস্তির ছবি দেখা যাচ্ছিল। আশেপাশে কিছু হোটেল মোটেলের অবস্থান দেখতে পেলাম। মেইনরোড আমরা এবার নেইভাসার পথে নেমে গেলাম। একে পথ না বলে খানাখন্দক বলাই ভালো। বড় বড় পাথর মাথা উঁচু করে আছে। ছোট বড় গর্তের কোন শেষ নেই। গাড়ী আটকে যায় কিনা এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই। কিন্তু হারুন সাহেব পাকা চালক। নানা কায়দা-কানুন করে গাড়ী পার করে নিয়ে যায়। আমরা এসে হাজির হলাম একটা মাঠের মধ্যে। বেলা তখন বারটা সাড়ে বারটা বাজে। ছেলেমেয়েরা ফুটবল খেলায় মেতে উঠেছে। আমাদের গাড়ী দেখে এক কুতুব খেলা বাদ দিয়ে গাড়ীর কাছে হাজির হলো। বুঝলাম সে নৌকার একজন ব্রোকার। সে এসেই আমাদেরকে একটা বিগ ডিসকাউন্টের ঘোষণা দিয়ে দিল এবং কি কি দেখাবে তার ফর্দ হিসাব তুলে ধরল। কিন্তু হারুন সাহেব পাকা লোক। সেই জন বা জোসেফ যখন বিগ ডিসকাউন্টের পর ১০,০০০/ টাকা নৌকা ভাড়া দাবী করল তখন হারুন সাহেব বললেন, “আমরা বরং ডিসকাউন্ট ছাড়াই ভ্রমণ করতে চাই। এখন তুমি বলো ডিসকাউন্ট না দিলে তোমাকে কত দিতে হবে?” বেচারা ব্রোকার ধ্বন্দে পড়ে গেল।  পীড়াপীড়া শুরু করে দিল একটা দাম বলার জন্য। অনেক জোড়াজুড়ির পর হারুন সাহেব আড়াই হাজার টাকা ভাড়া বললেন। জন বেচারার ভিমরি খাওয়ার উপক্রম।এতক্ষণ গাড়ীতে বসেই কথা হচ্ছিল। দামাদামির আকাশ-পাতাল ফারাক দেখে আমি পরিবেশ পর্যবেক্ষণে মনোযোগী হলাম। কিন্তু গাড়ী থেকে নামতেই সামান্যের জন্য পবিত্র মস্তক পক্ষীকুলের বিষ্ঠা হতে রক্ষা পেল! কি ভেবে ছাতা সাথে নিয়েছিলাম। দৌঁড়ে  গিয়ে গাড়ী থেকে ছাতা বের করে নিলাম। কারণ, মাঠে যত গাছ আছে সব গাছেই হাজার হাজার পক্ষীকুলের বাস (আসলে কত পাখী আছে কে জানে?)। লেকের মৎস্যকুলের গুষ্টি সাবার করে গাছে গাছে নিজ নিজ বাসায় বসে বংশবৃদ্ধির কাজ চালায় আর ক্ষণে ক্ষণে বিষ্ঠা ছাড়ে। তারা তো আর বুঝে না কার ঘাড়ে বা মাথায় তা পড়ে বা না পড়ে। আমি নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে পক্ষীকুলের বাসার হিসাব নিকাশের চেষ্টা করতে করতেই হারুন সাহেব কোন যাদুমন্ত্র বলে নৌকার ভাড়ার হিসাব মিলিয়ে ফেলেছেন বুঝতেই পারিনি। এর মধ্যে আরেক উৎপাদ হাজির হলো। লেক থেকে ধরা তেলাপিয়া মাছ ভেজে ভেজে দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকজন নারী এসে অনুরোধ করতে থাকে মাছ খেতে। অবশ্যই ফ্রি নয়। কিন্তু সমস্যা হলো তাদের মাছ ভাজা খেয়ে সুস্থ শরীরে নাইরোবী ফিরে যেতে পারব কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ থাকায় আমরা শত অনুরোধ এড়িয়ে নৌকায় আরোহন করি। ফাঁকতালে হারুন সাহেবের কাছ হতে জেনে নেই মাত্র ৩ হাজার টাকায় দুই ঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়ার হিসাব মিলানো হয়েছে।

নৌকার মাঝি আমাদেরকে লাইফবেল্ট পড়িয়ে দেন। তারপর নৌকা চালাতে শুরু করে। প্রথম দর্শনীয় বিষয় ছিল জলহস্তী দর্শন। আমার ধারণা ছিল হয়তো দু একটি জলহস্তী হবে। কিন্তু না দু একটি নয় বেশ অনেকগুলো জলহস্তী হুস হুস করে জলের উপর মাথা তুলছে আমার জলের নীচে চলে যাচ্ছে। কখনো কখনো একই সাথে একাধিক জলহস্তীর জলের উপর মাথা তুলছে। কোন কোনটি বড় আবার কোন কোনটি বাচ্চা। নৌকার মাঝি কিছু সময়ের জন্য নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। আমরা অনেক অনেক ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। পাড়েই হাজার হাজার পাখির মেলা। দেখে মনে হলো ওরা বোধহয় রোদ পোহাচ্ছে। হাড়গিলা জাতীয় পাখী ডানামেলে আছে তো আছেই। তার পাখা মেলা দেখে মনে হলো সে বোধ প্রতিজ্ঞা রক্ষা করছে। জলের মধ্যে বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছে যেহেতু কোন ডালপালা নেই, তাই পাতা থাকার প্রশ্ন অবান্তর। শিরীষ গাছের মতো তাদের চেহারা। কিন্তু ডালপালা আর লতাপাতা ছাড়া এসব গাছ যেন বৈদ্যুতিক খুঁটির খাম্বা ছাড়া আর কিছু নয়। কতগুলো গাছের মাথায় বসে রোদ পোহাচ্ছে অচেনা কোন কোন পাখী। একটি পাখীকে দেখে মনে হলো সে হাত পা ছেড়ে আরাম করার ভঙ্গিতে বিশ্রাম নিচ্ছে। নৌকার যাওয়া আসাতে এদের কোন বিকার নেই। জলহস্তি দেখার পর্ব শেষ হলে নৌকা এগিয়ে চলল প্রধান আকর্ষণের পানে। আমাদের কল্পনাকে হার মানানো এক আকর্ষণ।

চলবে