অভিজ্ঞ নেতারা টীমের কথা শোনেন

নেতা আর কর্মী এক নয়। নেতার অধীনে কর্মী কাজ করে। নেতা যদি কর্মীর পর্যায়ে নেমে আসেন তাহলে তিনি আর নেতা থাকেন না। কিন্তু অভিজ্ঞ নেতারা সরাসরি কর্মীর সাথে কথা না বললেও তারা কর্মী ব্যবস্থাপনার এবং নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেন। তারা টীমের কথা শোনেন এবং প্রয়োজন মতো নির্দেশনা দেন। তাদের নির্দেশনা সকল স্তরে ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হয়ে টীমের কাজ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং কাঙ্খিত লক্ষ্যার্জন করে।

কিন্তু অনভিজ্ঞ নেতারা প্রথমে পরিচালনার নির্দেশ দেন -তারপর কথা শোনেন। তাও যদি তারা কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেন তবে। ফলে তারা কর্মীদের হৃদস্পন্দন বুঝতে পারেন না, কর্মক্ষেত্রে বা বাস্তবে কি সমস্যা রয়েছে, নির্দেশ পালনে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তা উপলব্ধি করতে পারেন না। তারা জানতে পারেন না বাস্তব কাজ করার জন্য কি কৌশলগত পদক্ষেপ, উপায় উপকরণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। টীমের অস্তিত্বের জন্য কোন হুমকী আছে কিনা, টীমের মধ্যে দ্বান্দ্বিকতাপূর্ণ বা সংঘাতমূলক পরিস্থিতি বিরাজ করছে কিনা, টীমের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কি পরিস্থিতি বিরাজমান করছে তাও তারা জানতে পারেন না।

অভিজ্ঞ ও ভালো নেতৃত্ব সব সময় একথা স্মরণে রাখেন যে যারা বাস্তব কাজ করে তারা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ। ফলে এমন নেতৃত্ব বাস্তবে যারা কাজ করেন তাদের কাজের সীমাবদ্ধতা দূর করে তাদেরকে আরও কার্যকর ও দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অধীনস্তরা যদি তাদের নির্দেশ অনুসরণ না করেন তবে তারা তার কারণ জেনে নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। তারা খুব বেশী চাপাচাপি বা দলাদলি বা নিপীড়ন ও দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন টীমের উপর তাদের দখল আছে। ফলে তারা নেতৃত্বের পর্যায়ে অবস্থান করেই যে কোন অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। নেতৃত্বের পর্যায় হতে তারা কখনোই নেমে আসেন না। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, টীমের কথা শুনলেই টীম তাদের প্রতি আরও বেশী আনুগত্য প্রকাশ করবে এবং তাদের যে কোন নির্দেশ বাস্তবায়নে বিশেষভাবে তৎপর হবে। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, ”Experienced leaders listen before they lead. But immature leaders lead first, then listen afterward.”

এ প্রসঙ্গে General Tommy Franks এর বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন,” Generals are not infallible. The army doesn’t issue wisdom when it pins on the stars. Leading soldiers as a general means more than creating tactics and giving orders. Officers commanding brigades and battalions, the company commanders, and the platoon leaders—all of them know more about their unit strengths and weaknesses than the general who leads them. So, a successful general must listen more than he talks.”

শুধু টীমের কথা শোনার মধ্য দিয়েই অনেক সত্য বের হয়ে আসে। তাই যারা বাস্তব কাজ করে তাদের কথা শুনুন। তাহলে আপনার নেতৃত্ব দেওয়া সহজ ও সফল হবে। উদ্দেশ্যহীন টার্গেটে আপনার তীর ছোড়া বন্ধ হবে। আপনার লক্ষ্যার্জন সহজ হবে।

নেতিবাচক যোগ্যতা (“Negative Capability”) এবং আমাদের মন

আমরা এমন সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করি যেখানে সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ও অসম্মানজনক বিষয় হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক বিষয়ে আমাদের নিজেদের জ্ঞানভিত্তিক ও তথ্যভিত্তিক কোন মতামত থাকে না। কোন কোন সময় আমরা অপর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ বা ভাসাভাসা আবেগ ও প্রমাণহীন তথ্যের ভিত্তিতেই নিজেদের মতামত প্রকাশ করে থাকি। অন্যের ধারণা ও বিশ্বাস ধার করেও আমরা আমাদের মতামত প্রকাশ করতে পিছপা হই না। একাধিক কারণেই আমরা তা করি। এক. সময়ের অভাব; দুই. সত্য জানার জন্য আগ্রহের অভাব; তিন. চিন্তা শক্তির অভাব; চার.তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর তাড়না। ব্যক্তি বিশেষের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এসব কারণের সংখ্যা বাড়তেও পারে আবার কমতেও পারে। সমস্যা হচ্ছে আমরা যখন অন্যের ধারণার উপর ভিত্তি করে নিজেদের বিশ্বাস বা আস্থা বা মতামত লালন করি এবং সেই বিশ্বাস বা মতামত দ্বারা নিজেদের বাস্তবতা নিমার্ণ করি বা করার চেষ্টা করি তখন তা আমাদের বাস্তবতার সাথে যুতসই বা লাগসই হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কিংবা এ ধরণের মতামত বা বিশ্বাস আমাদের কাজ, উদ্দেশ্য বা বাস্তবতার প্রতিকূলেও কাজ করতে পারে বা সামনের পানে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। বাস্তব জীবনে আমাদের এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় যখন আমাদের নিজেদের মতামত ব্যক্ত করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কিন্তু অনমনীয় বা ধার করা বা ভাসাভাসা ধারণা প্রেক্ষাপটের সাথে যখন লাগসই হয় না তখন আমাদের চিন্তাশক্তির  দুর্বলতা প্রকাশ পায় বা আমার ক্ষতিগ্রস্ত হই। এমন পরিস্থিতিতে ‘আমি জানি না’ বা আমার জানা নেই’ এমন মন্তব্য পেশাগত অজ্ঞতা প্রকাশের নামান্তর হয়ে পড়ে। এ কারণে পরিস্থিতি অনুযায়ী মতামত প্রকাশের জন্য মনকে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হয়। আমি যা জানি তাই চরম সত্য নয়। আমার জানার বাইরেও সত্য আছে। আমি  যা বিশ্বাস করি তাই অন্যের কাছে চূড়ান্ত বিশ্বাস হিসেবে গণ্য নাও হতে পারে। । অন্যদের মতামত, বিশ্বাস ও চিন্তাও যে সঠিক হতে পারে তা মেনে নেয়ার মুক্ত মনোবৃত্তি থাকতে হবে। সে জন্য কোন বিষয়ে আমাদের মন তথা চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে, আদর্শগত অবস্থানও পরিবর্তন করতে হতে পারে। সর্বোপরি আমাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন  করতে হতে পারে।

পরিবর্তনকে মেনে নেওয়ার জন্য ক্ষমতার বা শক্তির প্রয়োজন হয়। এই শক্তিকে বলা হয় “Negative capability” বা ‘নেতিবাচক যোগ্যতা’। শুনতে নেতিবাচক মনে হলেও বাস্তবে ইহা ইতিবাচক। কারণ, পৃথিবী এক বিচিত্র স্থান। এখানে বিচিত্র মানুষের বাস এবং বিচিত্র মানুষের সাথে আমাদের যোগাযোগ ঘটে। শুধু মানুষ কেন বিচিত্র এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনাও কি কম ঘটে এ পৃথিবীতে! এক মুহূর্ত আগে যে আমার বন্ধু এক মুহূর্ত পরেই সে আমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। যাকে আমরা খুব ভালো মানুষ হিসেবে জানি ক্ষমতা বা স্বার্থের সিঁড়িতে আরোহন করে সে এমনভাবে পরিবর্তন হতে পারে যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। ব্যক্তি মানুষ নিজের স্বার্থ আদায় বা অহমকে প্রকাশের যে কেউ অন্যায় পন্থা ও পথও বেছে নিতে পারে। পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে বা রাষ্ট্রে এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও এ ধরণের ব্যক্তি ও ঘটনার কমতি নেই।

এসব ক্ষেত্রে “Negative capability” বা ‘নেতিবাচক যোগ্যতা’ আমাদেরকে প্রাথমিক ধাক্কা সহ্য করে করণীয় বিষয়ে ভাবার সুযোগ করে দেয়।  এই যোগ্যতা আমাদেরকে অনিশ্চয়তাকে মেনে নিতে, রহস্যের মধ্যেও বাস করে  রহস্যের কারণ ও প্রতিকার খুঁজতে, অস্পষ্টতার মধ্যে স্পষ্টতা ও শান্তির সন্ধান করতে সক্ষম করে তোলে। অসহনীয় বিষয়কেও মেনে নিতে শক্তি যুগিয়ে থাকে।

রোমান্টিক কবি হিসেবে খ্যাত জন কীটস তাঁর ভাই জর্জ এবং থমাসকে ১৮১৭ সালে যে সব পত্র লিখেছিলেন তা `Selected Letters of John Keats’ হিসেবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। ঐ সব পত্রে তিনি তাঁর ভাইদেরকে “Negative capability” এর কথা লিখেছেন। কাজেই জন কীটস হচ্ছেন “Negative capability” শব্দের স্রষ্টা বা উদ্ভাবক।

কালাপা টা কালা পর্ব-১

আমি উচ্চারণ করি কালাপা টা কালা। আমার মেয়ে উচ্চারণ করে কালা পা-টা কালা। প্লেটো বলেছিলেন, ‘ কালাপা টা কালা ’ অর্থাৎ ‘যা সুন্দর তা কঠিন ’(What that is beautiful is hard). . ব্যঙ্গ করে মেয়ে উচ্চারণ করে ‘ কালা পা-টা কালা ’ (The black leg is black). প্রথমে আমি মনে করতাম এটা উচ্চারণের বিভ্রাট। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার পর বুঝতে পারলাম এটা আসলে চিন্তার বিভ্রাট নয়। এটা উপলদ্ধির বিভ্রাট। উপলদ্ধির বিভ্রাট পক্ষপাতিত্বের কারণেও হতে পারে, আবার জ্ঞানের বা  জানার সীমাবদ্ধতার কারণেও হতে পারে। স্বার্থের কারনেও যে তা হতে পারে সে কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। আর স্বার্থ মানেই যে সেখানে অর্থ বা আর্থিক বিষয় বা বস্তুগত বিষয় থাকতে হবে তারও মানে নেই। আমার কাউকে পছন্দ হয় না, আমি কাউকে দাবিয়ে রাখতে চাই, কেউ আমার কাছে বিনা কারণে মাথা নত করুক, অন্য সবার মত হুজুর হুজুর করুক কিংবা প্রশংসা করতে করতে মুখ দিয়ে গ্যাজলা বের করুক এমনটাই আমি চাই। এমনভাবে ফেনা বের করুক যেন দেখে মনে হয় যে তার শরীরের ভেতরে ডিটারজেন্টের কারখানা আছে (হাসি)। এমনি আরও অনেক বিষয় আছে যা তুচ্ছ ও দুর্বল মানুষের কাছে ব্যাক্তিগত স্বার্থ মনে হয়। মানুষকে মর্যাদার চোখে না দেখে অমর্যাদা এবং অসম্মানের চোখে দেখাও তাদের কাছে স্বার্থ। তাদের ভাবনা অন্য কেউ নীচু হলেই না আমি উঁচু! এ সব ধ্যান ধারণা হচ্ছে বিকৃত মনের বিকৃত আকাংখা। শক্তিমান মানুষ কখনো মানুষকে উঁচু-নীচুর ভিত্তিতে দেখে না। দেখতে পারে না। দেখতে পারলে তারা আর শক্তিমান মানুষ থাকে না। নবী রাসুল ও অবতারগণ তা কখনো পারেননি। পারেননি পৃথিবীর অনেক বড় বড় মহামানব, নেতৃবৃন্দ, পন্ডিতগণ ও বিদ্যানরা। আবার পন্ডিত আর বিদ্যান হলেই যে বড় মনের, বড় হৃদয়ের মানুষ হবে তাও বোধহয় ঠিক না। নিজের স্বার্থের প্রশ্নে এরাও কম যায় না। স্বার্থের ঝোল টানতে এরাও বেশ ওস্তাদ। আর শিক্ষিতদের নিয়ে বড় বিপদ। কাজেই এদের বিষয়ে কথা  বলা  কঠিন এবং বিপদজনক। এরা যে কিসে মাইন্ড করে আর কিসে মাইন্ড করে না তা ভাবাও কঠিন। এই শিক্ষিত লোকেরাই বাংলা শোষণ করেছে ২৪ বছর। আর শিক্ষিত বৃটিশরা বাংলা শোষণ করেছে ২০০ বছর। এরা অবশ্য সারা দুনিয়াই শোষণ করেছে। তবে বাংলার শিক্ষিত লোকদের বিষয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে বলেছেন, ‘ ১৯ বৎসর পর্যন্ত চলেছে শোষণ আর লুন্ঠন। এখন এরা বুঝে ফেলেছে এদের জুলুম করার কায়দা কৌশল। তবে আর বেশীদিন নাই। যদিও জাতি হিসেবে বাঙালি পরশ্রীকাতর জাতি। ‘পরশ্রীকারতা’ দুনিয়ার অন্য কোন ভাষায় খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না, একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া।’

অবশ্য জার্মান ভাষায়ও একটি আজব শব্দ আছে অন্য ভাষায় যার প্রতিশব্দ নেই।

-চলবে।