নেতিবাচক যোগ্যতা (“Negative Capability”) এবং আমাদের মন
আমরা এমন সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করি যেখানে সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ও অসম্মানজনক বিষয় হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক বিষয়ে আমাদের নিজেদের জ্ঞানভিত্তিক ও তথ্যভিত্তিক কোন মতামত থাকে না। কোন কোন সময় আমরা অপর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ বা ভাসাভাসা আবেগ ও প্রমাণহীন তথ্যের ভিত্তিতেই নিজেদের মতামত প্রকাশ করে থাকি। অন্যের ধারণা ও বিশ্বাস ধার করেও আমরা আমাদের মতামত প্রকাশ করতে পিছপা হই না। একাধিক কারণেই আমরা তা করি। এক. সময়ের অভাব; দুই. সত্য জানার জন্য আগ্রহের অভাব; তিন. চিন্তা শক্তির অভাব; চার.তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর তাড়না। ব্যক্তি বিশেষের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এসব কারণের সংখ্যা বাড়তেও পারে আবার কমতেও পারে। সমস্যা হচ্ছে আমরা যখন অন্যের ধারণার উপর ভিত্তি করে নিজেদের বিশ্বাস বা আস্থা বা মতামত লালন করি এবং সেই বিশ্বাস বা মতামত দ্বারা নিজেদের বাস্তবতা নিমার্ণ করি বা করার চেষ্টা করি তখন তা আমাদের বাস্তবতার সাথে যুতসই বা লাগসই হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কিংবা এ ধরণের মতামত বা বিশ্বাস আমাদের কাজ, উদ্দেশ্য বা বাস্তবতার প্রতিকূলেও কাজ করতে পারে বা সামনের পানে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। বাস্তব জীবনে আমাদের এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় যখন আমাদের নিজেদের মতামত ব্যক্ত করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কিন্তু অনমনীয় বা ধার করা বা ভাসাভাসা ধারণা প্রেক্ষাপটের সাথে যখন লাগসই হয় না তখন আমাদের চিন্তাশক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায় বা আমার ক্ষতিগ্রস্ত হই। এমন পরিস্থিতিতে ‘আমি জানি না’ বা আমার জানা নেই’ এমন মন্তব্য পেশাগত অজ্ঞতা প্রকাশের নামান্তর হয়ে পড়ে। এ কারণে পরিস্থিতি অনুযায়ী মতামত প্রকাশের জন্য মনকে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হয়। আমি যা জানি তাই চরম সত্য নয়। আমার জানার বাইরেও সত্য আছে। আমি যা বিশ্বাস করি তাই অন্যের কাছে চূড়ান্ত বিশ্বাস হিসেবে গণ্য নাও হতে পারে। । অন্যদের মতামত, বিশ্বাস ও চিন্তাও যে সঠিক হতে পারে তা মেনে নেয়ার মুক্ত মনোবৃত্তি থাকতে হবে। সে জন্য কোন বিষয়ে আমাদের মন তথা চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে, আদর্শগত অবস্থানও পরিবর্তন করতে হতে পারে। সর্বোপরি আমাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে হতে পারে।
পরিবর্তনকে মেনে নেওয়ার জন্য ক্ষমতার বা শক্তির প্রয়োজন হয়। এই শক্তিকে বলা হয় “Negative capability” বা ‘নেতিবাচক যোগ্যতা’। শুনতে নেতিবাচক মনে হলেও বাস্তবে ইহা ইতিবাচক। কারণ, পৃথিবী এক বিচিত্র স্থান। এখানে বিচিত্র মানুষের বাস এবং বিচিত্র মানুষের সাথে আমাদের যোগাযোগ ঘটে। শুধু মানুষ কেন বিচিত্র এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনাও কি কম ঘটে এ পৃথিবীতে! এক মুহূর্ত আগে যে আমার বন্ধু এক মুহূর্ত পরেই সে আমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। যাকে আমরা খুব ভালো মানুষ হিসেবে জানি ক্ষমতা বা স্বার্থের সিঁড়িতে আরোহন করে সে এমনভাবে পরিবর্তন হতে পারে যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। ব্যক্তি মানুষ নিজের স্বার্থ আদায় বা অহমকে প্রকাশের যে কেউ অন্যায় পন্থা ও পথও বেছে নিতে পারে। পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে বা রাষ্ট্রে এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও এ ধরণের ব্যক্তি ও ঘটনার কমতি নেই।
এসব ক্ষেত্রে “Negative capability” বা ‘নেতিবাচক যোগ্যতা’ আমাদেরকে প্রাথমিক ধাক্কা সহ্য করে করণীয় বিষয়ে ভাবার সুযোগ করে দেয়। এই যোগ্যতা আমাদেরকে অনিশ্চয়তাকে মেনে নিতে, রহস্যের মধ্যেও বাস করে রহস্যের কারণ ও প্রতিকার খুঁজতে, অস্পষ্টতার মধ্যে স্পষ্টতা ও শান্তির সন্ধান করতে সক্ষম করে তোলে। অসহনীয় বিষয়কেও মেনে নিতে শক্তি যুগিয়ে থাকে।
রোমান্টিক কবি হিসেবে খ্যাত জন কীটস তাঁর ভাই জর্জ এবং থমাসকে ১৮১৭ সালে যে সব পত্র লিখেছিলেন তা `Selected Letters of John Keats’ হিসেবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। ঐ সব পত্রে তিনি তাঁর ভাইদেরকে “Negative capability” এর কথা লিখেছেন। কাজেই জন কীটস হচ্ছেন “Negative capability” শব্দের স্রষ্টা বা উদ্ভাবক।