নেতৃত্ব ও আস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক

নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জিং বিষয়। নামে নেতা আর কাজে নেতা এক নয়। নেতার প্রতি প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী বা দেশের মানুষের আস্থা থাকতে হয়। কিন্তু সহকর্মী বা মানুষের আস্থালাভ করাও খুব সহজ কথা নয়। নেতা কমিউনিটির উদ্দেশ্যে বা দেশের স্বার্থে কাজ করেন কিনা; নেতার কথা, নেতার নির্দেশনা যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবানুগ কিনা এমন সব বিষয় নেতার প্রতি আস্থা বা অনাস্থা সৃষ্টি করতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে বড় কথা নেতাকে অনুসারীরা নিজেদের নেতা হিসেবে মনেপ্রাণে সর্বান্তকরণে মেনে নেন কিনা তা নেতা এবং অনুসারী উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। অনুসারীগণ সব সময়ই নেতার চারিত্রিক দিক ও নেতার কাজ সচেতনভাবে অনুসরণ ও পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।

নেতৃত্বের পজিশনে থাকলেই একজন নেতা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন হবেন বিষয়টি এমন সরলসোজা নয়। নেতাকে কাজের মাধ্যমে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে পরীক্ষার মাধ্যমে অধীনস্ত বা অনুসারীদের বিশ্বাস বা আস্থা অর্জন করতে হয়। সুসংহত ব্যক্তিত্ব,কর্মতৎপরতা,ন্যায়পরায়ণতা,দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, কল্যাণকামী ও ত্যাগী মনোভাব এমন সব ইতিবাচক চারিত্রিক গুণের মাধ্যমে নেতাকে অন্যদের আস্থা অর্জন করতে হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা,চেগুয়েভারা,  নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধীর মতো নেতারা ছিলেন এসব গুণে গুনান্বিত নেতা।

নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নেতাকে ১০০% আস্থা অর্জন করতে হয়। এক্ষেত্রে ৬০% বা ৮০% আস্থা বলে কিছু নেই। আবার নেতৃত্বে সাময়িক আস্থা বলেও কিছু নেই। সময় ও সুযোগ অনুযায়ী যে নেতৃত্ব পক্ষপাতমূলক অবস্থান গ্রহণ করেন ঐ নেতৃত্বের প্রতি অধীনস্ত, অনুসারী বা দেশের সাধারণ মানুষের কোন আস্থা থাকে না। এজন্যই বলা হয় “Leadership is indivisible and trust is unquestionable.”

দুর্বল বা প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্র, অশালী ও অমার্জিত কথাবার্তা নেতার অন্যান্য সকল গুণাগুণকে ম্লান করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে নেতৃত্বের সকল প্রভাবই ক্ষুন্ন ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। নেতৃত্ব ও আস্থা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আস্থার মাধ্যমেই নেতার সাথে অধীনস্ত বা অনুসারীদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মানুষ যাকে আস্থাশীল মনে করে না তার প্রতি আনুগত্যও প্রকাশ করে না। প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে দুর্বল ও আস্থাহীন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনে বড় অন্তরায়। কারণ নেতার প্রতি আনুগত্যের অভাবই অনুসারীদেরকে তার বা তাদের আদেশ পালনে বিমুখ ও বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। শুধু পজিশনের কারণেই অনুসারীরা নেতার প্রতি শতভাগ আনুগত্য স্বীকার করে না। বরং নেতার কথা ও কাজ, স্বভাব-চরিত্র,নির্দেশদানের ক্ষমতা,অনুসারীদের প্রতি মমত্ববোধ,অনুসারীদেরকে নিজের লোক বলে স্বীকার করা এবং কাজের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ,দেশপ্রেম ইত্যাদি গুণাবলীর দ্বারাই নেতৃত্ব অনুসারীদের কাছে আস্থাভাজন হন।

মহাবীর আলেকজান্ডার ১০ বছরব্যাপী অপরাজেয় যুদ্ধে গ্রীস, মিশর এবং বৃহত্তর পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে নিয়েছেলিনে এবং সেসব স্থানে তাঁর শাসন কায়েম করেছিলেন।

আলেকজান্ডার তারপরও খুশি ছিলেন না। তিনি ভারতবর্ষ জয়ের উদ্দেশ্যে তাঁর অভিযান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১০ বছর ধরে অব্যাহত যুদ্ধ করার কারণে এবং এ দীর্ঘ সময় বাড়ি থেকে তথা পরিবার-পরিজন হতে দূরে থাকার কারণে তাঁর সৈন্যবাহিনী আরেকটি যুদ্ধ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। আলকেজান্ডার সৈন্যদের মধ্যে তাঁর প্রতি আস্থার সংকট লক্ষ্য করে তাদেরকে উজ্জ্বীবিত করার জন্য এক ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি তোমাদের কমান্ডার হিসেবে, তোমাদের ক্লান্তিকর যাত্রা এবং দুর্ভোগময় অভিযানের শরিক না হয়ে প্রথমবারের মতো তোমাদের নিরাশ হওয়াকে দোষ দিতে পারি না।

যখন সমগ্র এশিয়া জয় করা হবে, তখন প্রকৃতপক্ষে আমি আমাদের প্রত্যাশার সন্তুষ্টিকে ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে যাব: তোমরা প্রত্যেকে ধনসম্পদ ও ক্ষমতার যে সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত পাওয়ার আশা পোষণ করো তা ছাড়িয়ে যাব, এবং যারা বাড়ি ফিরে যেতে চাও তাদেরকে ফিরে যেতে দেওয়া হবে, আমার সাথে অথবা আমাকে ছাড়া। যারা থেকে যাবে তাদেরকে আমি যারা ফিরে যাবে তাদের কাছে হিংসার উপযুক্ত করে তুলব।”

অনুসারীদের মধ্যে আস্থার সংকট যে কোন সময়ই তৈরী হতে পারে। একজন নেতার পক্ষে তা বুঝতে পারা এবং তদানুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাও নেতৃত্বের বড় গুণ।

  • মোঃ বদিউজ্জামান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *