নেইভাসা লেকে ভেসে চলা, মেঘ-পাহাড়ের সাথে কথামালা

নেইভাসা লেকে ভেসে চলা, মেঘ-পাহাড়ের সাথে কথামালা -মোঃ বদিউজ্জামান
পর্ব-১

কেনিয়া দেশটির নামকরণ হয়েছে মাউন্ট কেনিয়ার নামানুসারে। এই পর্বতের চূড়া সাদা বরফে ঢাকা থাকে। এর আশেপাশে যারা বসবাস করে তারা কিকুয়ু নামে পরিচিত। আটটি অঞ্চলে বিভক্ত কেনিয়া প্রকৃতির নানা বিস্ময়ে ভরপুর। সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকেরা আসেন কেনিয়া সফরে। আমার মতো বাঙালের তো সে দেশ সফরে যাওয়া কল্পনার অতীত ব্যাপার। কিন্তু সরকারী কাজ উপলক্ষ্যে এমন দুর্লভ সুযোগ যখন এসে গেল তখন আনন্দে উল্লসিত হওয়ার মতোই ঘটনা বটে। কেনিয়ার কোথায় যাব কি দেখব এ বিষয়ে নানাজন নানা পরামর্শ দিতে থাকলেন। ঘুরেফিরে মাছাইমারা সাফারীর কথা সবাই বলল। তাদের কথা শুনে মনে হলো আর কিছু না দেখলেও মাছাইমারা দেখতেই হবে। নির্ধারিত সময়ে আমরা যখন কেনিয়াতে পৌঁছালাম এবং অফিসের লোকজনের সাথে কথা বললাম তখন কিছুটা হতাশই হলাম। আইনশৃংখলাজনিত সমস্যার কথা ঘুরেফিরে শুনতে পেলাম। দ্বন্দ্ব আর ধন্দে পড়ে গেলাম। তাহলে কি কিছুই না দেখে ফিরে যেতে হবে? এমনি পরিস্থিতির মধ্যেই আমরা দাপ্তরিক ছুটির দিনে বের হলাম নেইভাসা লেক (Naivasha Lake) দেখার জন্য। নাইরোবি হতে লেক নেইভাসার দুরত্ব প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। গাড়ী প্রায় ২ ঘন্টা ত্রিশ মিনিট সময় লাগে। নাইরোবি হতে বের হয়ে হাইওয়েতে উঠার পর সারাটা রাস্তাই মসৃন ও জ্যামমুক্ত। অবশ্য স্থানে স্থানে পাহাড় ধ্বসের কারণে কিছু ডি-রুটেড হয়ে চলতে হয়। তবে তা খুব সীমিত। হাইওয়ে পুলিশের নানা র্কীর্তিকলাপও অবশ্য নজরে পরতে পারে যদি চোখকান খোলা রাখা যায়। পাহাড়ের ভেতরে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে একেবেঁকে।দুপাশে পাইনগাছসহ নানা প্রজাতির গাছেরা শিড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় মেঘেরা এখানে গাছের মাথায় স্থায়ী আবাস গড়ে নিয়েছে। বিভিন্ন ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালে চারিদিকে পাহাড়ের মধ্যে বিস্তৃত মালভূমির মতো এলাকা দেখা যায়। ভালো করে তাকালে মেঘের আবছায়ার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের কোলের ও সমতলভূমির ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাটের ছবি দেখা যায়। কোথাও কোথাও হালকা মেঘের বাতাসে ভেসে বেড়ানো দেখে ধোয়ার ছড়াছড়ি বলে ভ্রম হয়। কোথাও কোথাও বেশ খোলামেলা প্রান্তর। প্রান্তর হতে দূরে বহু দূরে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। প্রান্তরে লাল কাপড় পড়ে মাছাই উপজাতির লোকেরা গরু ছাগল চড়াচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ রেলগাড়ীর হুস হুস আওয়াজ কানে আসে । তাকিয়ে দেখি ট্রেন যাচ্ছে। রাস্তায় তরুন নারী-পুরুষ ও বালক বালিকারা বাদাম, কমলা, কলা, ছফেদা বিক্রি করছে। অবাক করা ব্যাপার হলো কাউকে সিগারেট বা বিড়ি বিক্রি করতে দেখলাম না। অবশ্য কেউ কেউ পানি বিক্রি করছে কিন্তু কোক বিক্রি করছে না। প্রচন্ড রোদের মধ্যে তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব জিনিস বিক্রি করছে। কেউ কেউ অবশ্য আমাদের দেশের মাথালের মতো বস্তু বা টুপি পড়ে আছে। রাস্তার পাশের ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালেই হকার এসে হাজির হয়। কিছু একটা কেনার জন্য পীড়াপীড়া করতে থাকে। হারুনর রশিদ সাহেব আগেই বলে দিয়েছে এরা যে কোন পণ্য ৪/৫ গুণ বেশী দাম হাকে। সহজ উপায় হচ্ছে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করা। আন্দাজ করে যে কোন দাম বললেই ঠকার শতভাগ সম্ভাবনা। পাহাড়, মেঘ আর বন-বনানীর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে আসি লেক নেইভাসার কাছাকাছি। চার রাস্তার মোড়ে রাস্তার দিকনির্দেশক চিহ্ন নেইভাসার পথ দেখাচ্ছিল। কিছু কিছু সাইনবোর্ডে জলহস্তির ছবি দেখা যাচ্ছিল। আশেপাশে কিছু হোটেল মোটেলের অবস্থান দেখতে পেলাম। মেইনরোড আমরা এবার নেইভাসার পথে নেমে গেলাম। একে পথ না বলে খানাখন্দক বলাই ভালো। বড় বড় পাথর মাথা উঁচু করে আছে। ছোট বড় গর্তের কোন শেষ নেই। গাড়ী আটকে যায় কিনা এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই। কিন্তু হারুন সাহেব পাকা চালক। নানা কায়দা-কানুন করে গাড়ী পার করে নিয়ে যায়। আমরা এসে হাজির হলাম একটা মাঠের মধ্যে। বেলা তখন বারটা সাড়ে বারটা বাজে। ছেলেমেয়েরা ফুটবল খেলায় মেতে উঠেছে। আমাদের গাড়ী দেখে এক কুতুব খেলা বাদ দিয়ে গাড়ীর কাছে হাজির হলো। বুঝলাম সে নৌকার একজন ব্রোকার। সে এসেই আমাদেরকে একটা বিগ ডিসকাউন্টের ঘোষণা দিয়ে দিল এবং কি কি দেখাবে তার ফর্দ হিসাব তুলে ধরল। কিন্তু হারুন সাহেব পাকা লোক। সেই জন বা জোসেফ যখন বিগ ডিসকাউন্টের পর ১০,০০০/ টাকা নৌকা ভাড়া দাবী করল তখন হারুন সাহেব বললেন, “আমরা বরং ডিসকাউন্ট ছাড়াই ভ্রমণ করতে চাই। এখন তুমি বলো ডিসকাউন্ট না দিলে তোমাকে কত দিতে হবে?” বেচারা ব্রোকার ধ্বন্দে পড়ে গেল।  পীড়াপীড়া শুরু করে দিল একটা দাম বলার জন্য। অনেক জোড়াজুড়ির পর হারুন সাহেব আড়াই হাজার টাকা ভাড়া বললেন। জন বেচারার ভিমরি খাওয়ার উপক্রম।এতক্ষণ গাড়ীতে বসেই কথা হচ্ছিল। দামাদামির আকাশ-পাতাল ফারাক দেখে আমি পরিবেশ পর্যবেক্ষণে মনোযোগী হলাম। কিন্তু গাড়ী থেকে নামতেই সামান্যের জন্য পবিত্র মস্তক পক্ষীকুলের বিষ্ঠা হতে রক্ষা পেল! কি ভেবে ছাতা সাথে নিয়েছিলাম। দৌঁড়ে  গিয়ে গাড়ী থেকে ছাতা বের করে নিলাম। কারণ, মাঠে যত গাছ আছে সব গাছেই হাজার হাজার পক্ষীকুলের বাস (আসলে কত পাখী আছে কে জানে?)। লেকের মৎস্যকুলের গুষ্টি সাবার করে গাছে গাছে নিজ নিজ বাসায় বসে বংশবৃদ্ধির কাজ চালায় আর ক্ষণে ক্ষণে বিষ্ঠা ছাড়ে। তারা তো আর বুঝে না কার ঘাড়ে বা মাথায় তা পড়ে বা না পড়ে। আমি নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে পক্ষীকুলের বাসার হিসাব নিকাশের চেষ্টা করতে করতেই হারুন সাহেব কোন যাদুমন্ত্র বলে নৌকার ভাড়ার হিসাব মিলিয়ে ফেলেছেন বুঝতেই পারিনি। এর মধ্যে আরেক উৎপাদ হাজির হলো। লেক থেকে ধরা তেলাপিয়া মাছ ভেজে ভেজে দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকজন নারী এসে অনুরোধ করতে থাকে মাছ খেতে। অবশ্যই ফ্রি নয়। কিন্তু সমস্যা হলো তাদের মাছ ভাজা খেয়ে সুস্থ শরীরে নাইরোবী ফিরে যেতে পারব কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ থাকায় আমরা শত অনুরোধ এড়িয়ে নৌকায় আরোহন করি। ফাঁকতালে হারুন সাহেবের কাছ হতে জেনে নেই মাত্র ৩ হাজার টাকায় দুই ঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়ার হিসাব মিলানো হয়েছে।

নৌকার মাঝি আমাদেরকে লাইফবেল্ট পড়িয়ে দেন। তারপর নৌকা চালাতে শুরু করে। প্রথম দর্শনীয় বিষয় ছিল জলহস্তী দর্শন। আমার ধারণা ছিল হয়তো দু একটি জলহস্তী হবে। কিন্তু না দু একটি নয় বেশ অনেকগুলো জলহস্তী হুস হুস করে জলের উপর মাথা তুলছে আমার জলের নীচে চলে যাচ্ছে। কখনো কখনো একই সাথে একাধিক জলহস্তীর জলের উপর মাথা তুলছে। কোন কোনটি বড় আবার কোন কোনটি বাচ্চা। নৌকার মাঝি কিছু সময়ের জন্য নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। আমরা অনেক অনেক ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। পাড়েই হাজার হাজার পাখির মেলা। দেখে মনে হলো ওরা বোধহয় রোদ পোহাচ্ছে। হাড়গিলা জাতীয় পাখী ডানামেলে আছে তো আছেই। তার পাখা মেলা দেখে মনে হলো সে বোধ প্রতিজ্ঞা রক্ষা করছে। জলের মধ্যে বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছে যেহেতু কোন ডালপালা নেই, তাই পাতা থাকার প্রশ্ন অবান্তর। শিরীষ গাছের মতো তাদের চেহারা। কিন্তু ডালপালা আর লতাপাতা ছাড়া এসব গাছ যেন বৈদ্যুতিক খুঁটির খাম্বা ছাড়া আর কিছু নয়। কতগুলো গাছের মাথায় বসে রোদ পোহাচ্ছে অচেনা কোন কোন পাখী। একটি পাখীকে দেখে মনে হলো সে হাত পা ছেড়ে আরাম করার ভঙ্গিতে বিশ্রাম নিচ্ছে। নৌকার যাওয়া আসাতে এদের কোন বিকার নেই। জলহস্তি দেখার পর্ব শেষ হলে নৌকা এগিয়ে চলল প্রধান আকর্ষণের পানে। আমাদের কল্পনাকে হার মানানো এক আকর্ষণ।

চলবে

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *