যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী

-মোঃ বদিউজ্জামান ১১/০৭/২০২৪ খ্রি.

রবীন্দ্র সাহিত্য এখনো অনেক সময় কঠিন মনে হয়। আবার ছোট বেলায় পড়া ‘বীরপুরুষ’ কবিতার কথা মনে হলে এমন ভাবনায় ছেদ পড়ে। অর্থের পিছনে যে অর্থ থাকে, ভাবনার পিছনে যে থাকে ভাবনা, শক্তির পিছনে যে মহাশক্তি থাকে রবীন্দ্র সাহিত্য যত বেশী পড়ি ততবেশী তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। রবীন্দ্র সাহিত্য কতটুকু বুঝতে পারি তার চেয়ে আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ সাহিত্য পড়ে আমি ভাসতে পারি অকূল সাগরে, ডুবতে পারি অথৈ মহাসাগরে, উড়তে পারি মহাকাশে। জানা ও বুঝার বিস্তর ফারাক আছে তা জানি। তাই কখনো জানার জন্য, কখনো বুঝার জন্য আবার কখনো উপলব্ধির গভীর শিখড়ে পৌঁছার জন্য রবীন্দ্র সাহিত্যে অবগাহন করি। কোন কোন বিষয় বারবার পড়ি। কবি গুরুর ‘সোনার তরী’ কবিতা পড়ে মনের গভীরে প্রশ্ন জেগেছে এ কবিতায় তিনি আসলে কি বলতে বা বুঝাতে চেয়েছে?  কখনো তাঁর কথা আমি বুঝতে পারি আবার কখনো বুঝতে পারি না। এই যে ‘যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী’ বলতে তিনি কিসের আবেগ প্রকাশ করেছেন? কি ছিল নৌকায়?ধান। ধান আসলে কীসের প্রতীক? সম্পদ নাকি জীবন নাকি সময়ের? সোনার তরী কি?সোনার তরী কি মানুষের জীবন?জীবনের সময়? আমাদের কাছে বিবেচিত মূল্যবান সম্পদ? ভালোবাসা? স্নেহ? আবেগ? অনুভূতি?প্রেম?নাকি কালের গভীরে সব কিছুর হারিয়ে যাওয়া?হাজার বার চিন্তা করেও আমি এ জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর পাইনি । এ বছরের ৭ই জানুয়ারী যখন আমার জন্মদাতা ইহধাম ত্যাগ করেন তখন আমার মনে হয়েছে ‘সোনার তরী’ মানে সময়। সময়ের তরীতে ভর করে আমার চিরচেনা, চিরজানা,পরমপ্রিয়, চরম ভালোবাসার ধন রওয়ানা হয়েছিলেন অনন্তকালের মালিক যিনি তাঁর কাছে। সময় তরীর আকার-আকৃতি জানি না, লগি বৈঠার কোন কিছু চিনি না,মাঝি-মাল্লা কারা তাও জানি না শুধু জানি একজন মালিক আছেন যিনি সব কিছুর নিয়ন্তা, যিনি সবার কাছে অদৃশ্য আবার সবার কাছে দৃশ্যমান দয়া,করুণা ভালোবাসা, প্রেম, মুগ্ধতা, বিস্ময়,জিজ্ঞাসা, অনন্ত জিজ্ঞাসা রুপে। তাঁরই কাছে সব ধায়, তাঁরই কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি বিশ্বের সবকিছুর মধ্যে। তাই ভালোবাসার, প্রেমের, প্রকৃতির কবি গেয়েছেন,

“ ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা

প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে

যায় যেন মোর সকল গভীর আশা

প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে

 

চিত্ত মম যখন যেথায় থাকে

সাড়া যেন দেয় সে তোমার ডাকে

যত বাধা সব টুটে যায় যেন

প্রভু, তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে।”

 

বিশ্বের সবার ও সব কিছুর মধ্যে পরিপূর্ণতায় ভরে উঠার বাসনা কাজ করে। কিন্তু সব কিছুই কি পরিপূর্ণতায় ভরে উঠতে পারে?সবাই কি পরিপূর্ণতায় সিক্ত হতে পারে?পরিপূর্ণতার কি কোন পরিপূর্ণ সংজ্ঞা আছে? আমার নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করার ভাবনা ও তৃপ্তি কি অন্যের পরিপূর্ণ হওয়ার পথে বাধা?অন্যকেও পরিপূর্ণ হয়ে উঠার সুযোগ দেওয়া কি আমার, আমাদের দায়িত্ব নয়?চূড়ান্ত পরিপূর্ণতা কীসে? এমনি ধারা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসাও মনের মধ্যে কাজ করে। যখন পরিপূর্ণতার তৃপ্তি নিয়ে আর সন্তুষ্টিতে নিজেকে ভরপুর মনে হয় তখনই হয়তো সময় এমন কোন দফা নিয়ে হাজির হয় যখন সময়ের কাছে আত্নসমর্পনেই তৃপ্তি, আনন্দ আর মুক্তি। আমাদের পরিপূর্ণতার অংশ,আমাদের আপনজন যখন নিজেকে পরিপূর্ণ করার আনন্দে বিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে দেয়,আলো হয়ে উঠার তীব্র বাসনায় অনিশ্চয়তাকেও মেনে নিয়ে ছুটতে থাকে তখন আমরা বুঝতে পারি পরম প্রভুর ডাকে সে ছুটছে নবসৃষ্টির আনন্দে। এ ছোটাতে থাকে তৃপ্তি, সৃষ্টির আনন্দ, মুক্তির উচ্ছ্বাস,বিশ্বের নাগরিক হয়ে বিশ্বজনের সাথে মিলিত হওয়ার অবাধ বাসনা। এ বাসনা পূরণের যাত্রায় আমাদের পরিপূর্ণতায় ভাঙ্গন ধরে, আমরা হারানোর বেদনাভারে আক্রান্ত হই কিন্তু এ ভাঙ্গনেই নতুন সৃষ্টির জোয়ার আসে। সে জোয়ারকে রুদ্ধ করলে সময়ের দাবিকে রুদ্ধ করা হয়, সৃষ্টির পথে বাধার সৃষ্টি করা হয়, মুক্তির পথকে সংকুচিত করা হয়। সময় ছিনিয়ে নেয়, সময় কেড়ে নেয়। কিন্তু সব ছিনিয়ে নেওয়া, সব কেড়ে নেওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়। পরিপূর্ণ হয়ে উঠার জন্য সময়ের ছিনিয়ে নেওয়াকে মেনে নিতে হয়। মৃত্যুযাত্রাও কখনো কখনো মুক্তিযাত্রার মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে। তখনও আমরা সময়ের ছিনিয়ে নেওয়াকে অন্তর হতে মানতে পারি না। কিন্তু সময় তো আমাদের চাওয়া-পাওয়া, মেনে নেওয়া, মেনে না নেওয়াকে পরোয়া করে না। অতএব ‘যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী’ এ আক্ষেপ তখনো শুধু আক্ষেপ ও আর্তি হিসেবেই সময়ের প্রবাহে ভেসে বেড়ায়। আর সৃষ্টিই যেখানে মহত্বের মর্যাদা নিয়ে হাজির হয় সেখানে “যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী” এ বেদনাবোধকে শতকষ্ট হলেও আনন্দবোধের মহিমায় মেনে নিতে হয় । তাতে নিজেদের পরিপূর্ণতাবোধের তৃপ্তি কমলেও অন্যের পরিপূর্ণ হওয়ার আনন্দযাত্রাকে উপযাপন করা হয়,নবসৃ্ষ্টির বিজয়যাত্রার মহিমা কীর্তন করা হয়। সময় তার আপনবেগে মিলন ও বিচ্ছেদের খেলায় মত্ত। সময় তরীর এ জয়যাত্রাকে রুদ্ধ করার সাধ্য আছে কার?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *