নেইভাসা লেকে ভেসে চলা, মেঘ-পাহাড়ের সাথে কথামালা
নেইভাসা লেকে ভেসে চলা, মেঘ-পাহাড়ের সাথে কথামালা – মোঃ বদিউজ্জামান
পর্ব-২
আমাদের কল্পনা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায়। বিশেষ করে তা যদি মনের মাধুরীতে রাঙানো কোন স্থান, দৃশ্য, প্রেক্ষাপট বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে হয় । মনের ভেতর একটা উথাল-পাতাল ভাবনা নিয়ে আমরা সেই কাঙ্খিত স্থান, দৃশ্য বা ঘটনার দিকে যতটা এগুতে থাকি ততই বাড়তে থাকে আমাদের হৃদয় মনের উত্তেজনা ও চাপ। কল্পিত অপরুপ সুন্দর দেখার উত্তেজনাবোধ নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি লেকের মাঝখানের দ্বীপের দিকে।মনের উত্তেজনার বশে হঠাৎ করেই লেকের পানিতেও যেন গতি ও ঢেউ লক্ষ্য করি। হঠাৎ কিছুটা দমকা হাওয়া কোথা হতে যেন উড়ে আসে। হাওয়ার বেগের সাথে সাথে বাড়তে থাকে ঢেউয়ের বেগ ও গতি। ঘাট হতে নৌকাতে রওনা হওয়ার সময় একটুও ঢেউ ছিল না। লেকের ভেতর দিকে যতটা এগুতে থাকি ঢেউয়ের আকৃতি ক্রমিই বড় হয়ে উঠতে থাকে। পুরো লেক জুড়ে লক্ষ লক্ষ ঢেউ আর ঢেউ। দেখে মনে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ সাপের ফনা যেন সমান তালে নেচে চলেছে। যেখানে সূর্যের আলো পড়ছে সেখানকার পানির প্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে গলিত রুপার সাগরে ভাসছি। সেই রুপার মত পানির উপর সূর্যের আলো পড়ে চোখের তারায় তারায় নাচছে আলোর বিন্দু। পিলপিল করে ঢেউ এগিয়ে এসে নৌকার গাঁয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। ওদিকে শাঁ শাঁ করে পাখির দল উড়ে যাচ্ছে বিচিত্র কলরব তুলে। আবার কোন কোন পাখির ঝাঁক চক্রাকারে ঘুরছে লেকের উপর। গলা লম্বাওয়ালা হাঁস জাতীয় পাখি বিকট আওয়াজ করে হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে নিমেষেই গায়েব হয়ে চলে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার আড়ালে। কোথা হতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি গায়ে এসে পড়ল। খেয়াল করে দেখলাম একখন্ড মেঘ মাথার উপর ঝরে পড়ার অপেক্ষায় ঘোমটা দিয়ে অপেক্ষা করছে যেন আদেশ পেলেই ঝরঝর করে নেমে পড়বে নেইভাসার জলে। বেশ শংকায় পড়ে গেলাম। সাথে ছাতা একটা আছে । কিন্তু বাতাসে তা ঠিকে থাকবে এমন ভরসা পেলাম না। টিনের নৌকা বাতাসে এদিক ও দিক তুলছে তো তুলছেই। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আর ভাবছি নৌকা ডুবলে উদ্ধারকারী নৌকা আসতে কতক্ষণ দেরী হতে পারে। ততক্ষণ আমরা নেইভাসার জলে ভেসে থাকতে পারব তো! নাকি ঠাঁই হবে নেইভাসার অতল কালো জলে? এরই মধ্যে কেউ একজন নৌকার একপাশ হতে অন্যপাশে স্থান বদল করতে গিয়ে নৌকায় একঝলক পানি তুলে ফেলল। বলিহারী মানুষের আক্কেল আর জ্ঞান! কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ ফুস করে কালো দুটি পাখি ছড় ছড় শব্দ করে পানির ওপর দিয়ে যেন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বহুদূর পর্যন্ত ছুটে গেল। খেয়াল করে দেখলাম দুটি ঢাউস আকৃতির পানকৌড়ির কেরামতি। কালো মেঘের সাজগোজ দেখে যেন এদের মনে আনন্দের বান ডেকেছে। নাকি বিদেশী অতিথিকে আনন্দ দেয়ার দায় পড়েছে তাদের ওপর! মানুষ, প্রকৃতি আর পশু-পাখি কেউ তো আসলে আলাদা না। সেই প্রাকৃতিহাসিক কাল হতেই তো সবার একসাথে বসবাস ছিল। এখন না মানুষ নিজেদেরকে প্রকৃতি থেকে আলাদা ভাবতে চায়। সবার উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবী নিয়ে নিজেদেরকে জাতে তুলতে চায়! বিনাশ করতে চায় সৃষ্টির সব সুন্দর সূত্র আর নান্দনিকতা। আসলে তো সবাই প্রকৃতিরই সন্তান। পানকৌড়ির আনন্দ দেখে মনে মনে বলে উঠলাম সাবাস পানকৌড়ি! সাবাস! এ সময় আমার মাথায় এলো আল মাহমুদের কবিতার কথা। কি যে এক ঝামেলা! যখন যা মনে হবার কথা নয় তাই মনে হবে। তিনি ‘পানকৌড়ির রক্ত’ নামে একটা গল্পগ্রন্থ লিখেছেন। আমাদের সামনে পিছনে আর কোন নৌকা দেখা যাচ্ছিল না। মাঝিকে বললাম,‘সাবধানে চালাও।’ তার এক জবাব, ‘চিন্তা করো না।’ মনে মনে বললাম, ব্যাটা চিন্তা করলেই তুমি কি করতে পারবা আর না করলেই বা তুমি কি করতে পারবা তাকি আর আমরা জানি না? তুমি তো ব্যাটা উগালি খাবার পয়সা পেলেই খুশী । (উগালি কেনিয়ানদের একজাতীয় খাবার। আমাদের দেশের ভাপা পিঠার মতো। ঢাকা শহরের হাতের তালুতে দেখা যায় না এমন ভাপা পিঠা নয়। বিশাল আকৃতির ভাপা পিঠা। সাদা চাউলের অথবা কাউনের চাউলের ভাপা পিঠা। সামান্য চাপ দিলেই মোমের মতো গলে যেত। সে বহুকাল আগের কথা মা যখন এগুলো বানাত তখনকার কথা মনে হলো। কেনিয়ানরা অবশ্য সবজি দিয়ে খায়। হাল আমলে মাংস যোগ হয়েছে। কিন্তু তাদের কজনের ভাগ্যে আর মাংস জোটে?)। যাত্রী মরল না বাঁচল তাতে তোমার কী? আমিও ভাবাভাবি বাদ দিয়ে লেকের আয়তন পরিমান করার চেষ্টা করলাম। নাহ! আন্দাজ করা সম্ভব নয় । যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। হিসাব করে থৈ পাওয়া যাবে না। তাই প্রকৃতি দর্শন আর ছবি তোলায় মন দেই। মেঘ ভেসে এলে মেঘের রঙে পানির রঙ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। মেঘ সরে গেলে পানি ভিন্ন রঙধারণ করছে। মেঘ, পানি, ঢেউ আর পাহাড়ের খেলা দেখতে দেখতেই কুড়ি মিনিট কেটে গেল কিভাবে জানি না। বিচিত্র পাখির ডাকে সামনের পানে তাকালাম। বিস্ময়ে নেচে উঠল মনপ্রাণ! সামনে হরিণ, জেব্রা, বানর, ওয়াইল্ড বিষ্টের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে যে যার ইচ্ছামত। কালোমুখ বানরের দলের কেউ কেউ মাঠে ছুটে যাচ্ছে তো কেউ কেউ মরা গাছের শাখায় তরতর করে উঠে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার রোদে গাঁ মেলে দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। বালিহাঁসের মতো দেখতে হাঁসের ঝাঁক কলরব করে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করছে আর খাবার খুঁজে নিচ্ছে পানিতে ডুব সাঁতার কেটে। লম্বা লেজওয়ালা ওটা কি পাখী? দুপায়ের উপর ভর দিয়ে বুক পর্যন্ত পানিতে ভাসিয়ে ঘাড়ের উপর সাদা, কালো লম্বা গলা আর লম্বা ঠোঁটের মাঝখানে কালো দাগওয়ালা স্যাডেল বিলড সারস প্রজাতির বিশালাকৃতির পাখিটি যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিকারের আশায়। একঝাঁক হাফ-কলারড কিঙফিশার রঙের বাহার ছড়িয়ে এ গাছে ও গাছে উড়ছে আর ঝুপ করে পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করছে। জলের কিনারে নানা প্রজাতির পাখিদের মৎস্য শিকারের ধুম পড়েছে। এদের বেশীর ভাগ পাখির নাম জানি না।
নৌকা দেখে হরিণের দল যেন স্থবির হয়ে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখে দুনিয়ার বিস্ময় নিয়ে দেখছে আমাদের। দেখতে দেখতেই তাদের সাথে যোগদিল আরেক দল শিংওয়ালা হরিণের দল। দলে কতগুলো শিশু হরিণ তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে তো লাফাচ্ছেই।
জেব্রার দলের যেন কোন বিকার নেই। আপন মনে ঘাস খাচ্ছে তারা। কারা এলো আর কারা গেলো তাতে তাদের কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। হঠাৎ কী হলো জানি না। তারা দিগবিদিক ছুটাছুটি শুরু করল। তাদের দৌঁড় প্রতিযোগিতার দিকে তাকাতে না তাকাতেই পেলিকানের ডাক কানে এলো। একঝাঁক সাদা পেলিক্যান খাবার খোঁজায় ব্যস্ত। কতগুলো পেলিক্যান দলছুট হয়ে জলকেলীতে মত্ত। পাখা ঝাপটাচ্ছে আর কলরব করছে। এত বড় বড় পেলিক্যান আগে কখনো দেখিনি। কি মনে করে তারা একসাথে উড়াল দিলো। উড়ে অবশ্য খুব বেশী দূরে গেল না। কিন্তু পুরো দল যখন উড়াল দিলো তখন অনিন্দ্যসুন্দর এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। উড়াল দিয়ে আমাদের বুঝাল যে তারা উড়তেও পারে! মাঝিকে কিছু সময়ের জন্য নৌকা স্থির করে চুপচাপ বসে থাকতে বললাম। সিদ্ধান্ত হলো কেউ কোন কথা বলবে না। একদম নিঃশব্দ নীরবতা ও মৌনতা পালনের প্রতিজ্ঞা নিলাম। কানে ভেসে আসছে হরিণের ডাক, জেব্রার ডাক আর নাম না জানা পাখির গান, কলরব। নৌকায় চারজন মানুষ কিন্তু যেন কেউ নেই নৌকায় এমন নীরবতা বিরাজ করছে। সবাই নিস্তব্ধ বসে আছি। অনেকক্ষণ পর নতুন এক শব্দে আমাদের তন্ময়তা ভেঙ্গে খান খান হলো। দশ-বারোটি ওয়াইল্ড বিষ্ট একে অন্যকে সশব্দে তাড়া করতে করতে একদম পানির কিনারে এসে হাজির হলো। বিচিত্র তাদের গলার স্বর যা আগে কখনো শোনার সৌভাগ্য হয়নি। এদের দৌঁড়াদৌঁড়ি ও ডাকাডাকি দেখে শুরু হয়ে গেছে বানরের দলের ডাকাডাকি, লাফালাফি। এখানে হরিণের শরীরের রঙ যেন উজ্জ্বলতায় চমকাচ্ছে। প্রতিটি প্রাণী হৃষ্টপুষ্ট আর স্বাস্থ্যবান। খাবারের পাশাপাশি নীরব নির্ভয় প্রকৃতি যেন তাদের জীবনের সব শঙ্কা কেড়ে নিয়েছে। দিয়েছে অনাবিল আনন্দে জীবন উপভোগের অবারিত সুযোগ।
এবার নৌকা এগুতে থাকলো সামনের পানে। উদ্দেশ্য জিরাফ দেখা। কিন্তু জিরাফের দেখা মিলছে না। কিছুটা বাঁক ঘুরতেই দেখা মিলল আরেক ঝাঁক পেলিক্যানের। কিছু পেলিক্যান পানিতে খাবার খোঁজায় ব্যস্ত আর কিছু পেলিক্যান সারিবদ্ধভাবে রোদে গাঁ মেলে বসে আছে। মাঝি কোন প্রকার শব্দ করতে নিষেধ করল। কিন্তু আমরা শব্দ না করলে কী হবে পেলিক্যানের দল হঠাৎ করে বিকট আওয়াজ করতে করতে পানিতে নেমে গেল। আমাদের নৌকা হতে খানিকটা দূরে একটি নৌকা এসে ফিরল। নৌকায় বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় নারী-পুরুষকে দেখা গেল। তারা একদম চুপচাপ।বাইনোকুলার দিয়ে দেখছে আর নানা ধরনের ক্যামেরায় ছবি তুলছে। মাঝিকে আমরা পুরো দ্বীপটা ঘুরে দেখাতে প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু তার ঐ এক কথা ফোন দিয়ে মালিকের সাথে আগে কথা বলতে হবে। যতই বলি ঘন্টা হিসেবে টাকা বাড়িয়ে দেব তবু তার কথা একটাই মালিকের সাথে কথা বলতে হবে।
আমাদের ক্রয় করা সময় শেষ। এবার ফিরতে হবে। কিন্তু ঢেউ তখনও কমেনি। তবু ফিরতে হবে। মাঝি নৌকা ঘুরাল। দূরে পাহাড়, গ্রাম, বিশালাকৃতির গাছের সাড়ি সাড়ি মেলা আর মেঘের মেলার মিলন দেখে মনে হলো আরও কিছুটা সময় যদি থাকা যেতো। কিন্তু জীবনের সময় বড় কম। জীবনের সঞ্চয় আরও কম। তাই বুঝি কবিগুরু বলেছেন,“হায়রে হৃদয় তোমার সঞ্চয়, দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।”
নৌকা চলছে ঘাটের দিকে। চলতে চলতে নৌকা এসে থামল আরেকটি স্থানে যেখানে হাজার পাখির মেলা বসেছে। পাখির মেলার মাঝে ৮-১০টি ওয়াইল্ড বিষ্ট মনের সুখে ঘাস খাচ্ছে। এগুলো আকৃতিতে কিছুটা ছোট হলেও ওজনে কমপক্ষে ৫০-৬০ কেজি হবে। অন্য কেউ নামল না। আমি নেমে খুব কাছে গেলাম। তাদের সাথে ছবি তুললাম। ওদের তেমন কোন ভাবান্তর দেখলাম না। কেয়ারটেকার কিছু পয়সার বায়না ধরল। অগত্যা কিছু পয়সা দিতে হলো। কিছু তো দিতে হয়। জীবনের সব সঞ্চয় তো শুধু নিজের জন্য নয়। পরম প্রভু কার রিজিক কার কাছে জমা রেখেছেন তা আমাদের সীমিত চিন্তা শক্তিতে সব সময় বোধগম্য নয়। নেইভাসা লেকের জেমস বা গোমেজের চোখের ঝিলিক এখনও আমার চোখের তারায় নেচে উঠে, ছন্দসুরে কথা কয়। বিশ্বপ্রকৃতির স্রষ্টা যিনি সব কিছুতে তার মহিমা প্রকাশিত,তাঁর গুণগান ও জয় সর্বত্র।